মোনায়েম খানের রক্ষীরা আতশবাজির মতো গুলি ফুটিয়েছিলhttp://opinion.bdnews24.com/20
মোনায়েম খান শহীদ! | 174869 | Bangladesh Pratidin
মোজাম্মেল হক বীরপ্রতীক
১৯৭১ সালে আমি ছিলাম স্টাফ ওয়েলফেয়ার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। কম বয়স সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। যুদ্ধ করি ২নং সেক্টরের অধীনে। 'ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প' নামে একটি গেরিলা গ্র"পের সদস্য হিসেবে আমি ঢাকায় পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি।
ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রাণ বিসর্জন, নারীর সম্ভ্রমহানি আর বিপুল রক্তক্ষয়ের পর এসেছিল এই স্বাধীনতা, বিজয়। বিশ্বের কোনো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে কি না, জানি না। আমরা গর্বিত জাতি। বিশ্বের প্রশিক্ষিত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে আমরা হারিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু এজন্য আমাদের অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে। বাঙালির এই বিজয়গাথা বিশ্বের ইতিহাসে অন্য রকমভাবে স্বীকৃত। যদি বলি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশের স্বাধীনতার প্রাক-প্রস্তুতি, তাহলে ভুল হবে কি? স্বাধীনতাহীনতায় কেউ যে বাঁচতে চায় না, যুগে যুগে বাঙালি জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। বাঙালির গৌরবগাথা বিশ্ব-ইতিহাসে অন্য রকমভাবে স্বীকৃতও। স্বাধীন-সার্বভৌম স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়েই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল। সেই ডাকে মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে। আমাদের স্বাধীনতা কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের ফল নয়। বাঙালির তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ প্রত্যয় বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে দেশটির জš§ দেয়। স্বতন্ত্র মানচিত্র নিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের পরিচিতি এক অনন্য ভাস্বর রূপে প্রস্ফুটিত।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। যুদ্ধ দিনের কিছু কথা আজ লিখছি। মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশনটিও পরিচালিত হয়েছিল ডিসেম্বর মাসেই। শুধু সম্মুখসমরে নয়, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও যে পাক হায়েনারা পরাজিত হয়েছেÑএটি পৃথিবীকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এ অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। আমার আক্রমণে মোনায়েম খানের মৃত্যুর পর অনেকের কাছে এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানিদের পরাজয় সময়ের ব্যাপারমাত্র। আমরা 'ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প' পাকিস্তানি মিলিটারির অ্যামবুশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যখন আবার মেলাঘরে ফিরে যাই, তখন আমাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর হায়দার সামরিক কায়দায় আমাদের বললেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প যেহেতু অ্যামবুশে পড়েছে, সুতরাং তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। তাই তাদের দ্বারা গেরিলা অপারেশন অথবা সম্মুুখসমর সম্ভব নয়। তাদের দিয়ে আর্মস-অ্যামিউনেশন বহন করা ছাড়া আর কোনো কাজ করানো যাবে না। এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আমাদের মধ্যে দারুণ হতাশার সৃষ্টি করে। আমরা মনে খুব কষ্ট পাই। ট্রেনিং শেষে প্রায় প্রতিদিন আমরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। একদিন তিনি ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তোমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী? বললাম, স্যার আমাদের গেরিলা যুদ্ধে পাঠান। তিনি বললেন, তোদের গেরিলা যুদ্ধে পাঠিয়ে কী হবে? তোরা তো মানসিকভাবে পরাস্ত। আমরা বললাম, না স্যার, আমরা মানসিকভাবে পরাস্ত হইনি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বল, কাকে মারতে পারবি? নানা কথার পর আমি বললাম, স্যার আপনিই বলেন, কাকে মারব? তিনি বললেন, মোনায়েম খানকে মারতে পারবি? তিনি তার প্রশ্ন শেষ করার আগেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মোনায়েম খানকে মারতে পারলে কী দেবেন? তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আমি আজই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"পকে পাঠিয়ে দেব। বনানী কবরস্থানে মোনায়েম খানের স্ত্রীর কবর অবস্থিত। সেখানেই গরু চরানোর সময় তার গরুর রাখাল মোখলেছুর রহমান ও শাহজাহানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিকল্পনা হয়। তার সাহায্যেই আমরা মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করি। সে এক বিশাল স্মৃতি।
মোনায়েম খানকে হত্যা করা হয়েছিল সন্ধ্যার সময়। সন্ধ্যায় যখন মোখলেছুর গরু নিয়ে বাসায় ফেরে, তখন আমরা তার সঙ্গে মোনায়েম খানের বাড়িতে ঢুকে কলার বাগানে লুকিয়ে থাকি। বাড়ির ভেতর ঢুকে সে মোনায়েম খানের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। তখন মোখলেছ এবং শাহজাহানকে আমরা সরে যেতে বলি। ওরা সরে গেলে আমরা অপারেশন পরিচালনার জন্য সামনের দিকে মার্চ করি। মোনায়েম খান তখন ড্রইংরুমে ছিল। ড্রইংরুম খোলা ছিল। রুমের ভেতর পশ্চিম দিকে মুখ করে সোফায় বসা ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন এবং তার জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল আর মাঝখানে মোনায়েম খান। সে সময় ইন্ডিয়ান স্টেনগানে আমরা ফায়ার ওপেন করি। কিন্তু তখন অস্ত্র আমাদের সঙ্গে বিট্রে করে। এসএমজি থেকে একটা বুলেট বের হওয়ার পর ফেঁসে যায়। চেম্বারে গিয়ে দ্বিতীয় বুলেট আটকে যায়, বুলেট আর বের হয়নি। পরে জানতে পারি, সেই একটি গুলিতেই মোনায়েম খান প্রাণ হারায়। তারপর আমরা ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করি। সেটিও বিস্ফোরিত হয়নি। আমরা দৌড়ে তার বাড়ির দেয়াল টপকে বনানী কবরস্থানে চলে যাই। সেখানে দেয়াল টপকানোর সময় আমার পকেটে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেডটা পড়ে যায়। আমরা বনানী লেকের দিকে চলে যাই। মোনায়েম খানের বাড়িতে বেলুচ রেজিমেন্টের যে এক প্লাটুন পুলিশ ছিল, তারা সবাই চোখ বুজে শুয়ে উপরের দিকে আড়াল দিয়ে সিগারেট টানছিল। আমরা চলে যাওয়ার পর তারা আকাশের দিকে ফায়ারিং শুরু করে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে। তাদের ফায়ারিংয়ে নিউ ইয়ার উৎসবের আতশবাজির মতো আলোকিত হয়ে গিয়েছিল ঢাকার আকাশ। চারদিকে যেমন ছিল গুলির শব্দ, তেমনি আকাশে ছিল আলোর ঝলকানি। তখন যেন শুধু গুলির শব্দই সব দখল করে নিয়েছিল।
অপারেশন শেষ করে আসার সময় আমার ভাতিজা ইস াফিল খন্দকারের (এখন উপ-সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ) দোকানের পাশে এসে দরজা নক করে আমি পানি পান করতে চাইলে তিনি আমাকে পানি দেন। এরপর এয়ার ফোর্সের সার্জেন্ট আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের কাছে স্টেন দেয়ার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম, মোনায়েম খানের সেই দু'জন কর্মচারী মোখলেছুর ও শাহজাহান, আনোয়ার হোসেন বীরপ্রতীক, আমার বাবা, মা সবাই আমার চারপাশে বসা। তারা আমাকে রূপগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য বললেও আমি যেতে রাজি হলাম না। আমি বাড়িতেই থাকতে চাইলাম। বাংলা ঘরে আমি শুয়ে ছিলাম। সকালবেলা আমার দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে? আমার জ্যাঠা মালেক মাস্টারের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, রাতে আকাম করে এসে এখনো ঘরে শুয়ে আছো? আমি বললাম, কেন কী হয়েছে? তিনি বললেন, মোনায়েম খান মারা গেছে। মিলিটারি এসে এখন আমাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। মোনায়েম খানের মৃত্যুর কথা আমি জ্যাঠার কাছে শুনতে পাই।
তখন এটা বাইরের কেউ জানত না। যুদ্ধের পর পুরানা পল্টনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গড়ে ওঠে। সেখানে মেজর হায়দার আমাদের একশ' টাকা সম্মানী হিসেবে দেন। সে অনুষ্ঠানে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায়। তিনি আমাকে জানান, পুরস্কারের তালিকায় আমার নাম আছে। পরে পত্রিকায় দেখলাম বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকায় আমার নাম আছে। এরপর বিষয়টি মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তখন থেকেই মানুষ ঘটনাটি জানতে পারে। প্রত্যেকটা সেক্টরেই এরিয়াভিত্তিক একেকটি গেরিলা গ্র"প অপারেশনে পাঠানো হতো। আমাদের পাঠানো হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প নাম দিয়ে। গ্র"পের সদস্যরা ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা। আমাদের গ্র"পের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৩ জন। আমাদের গ্র"প কমান্ডার ছিলেন এমএ লতিফ। আমাদের অপারেশন করতে হতো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়, বনানী ও গুলশানে। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরের আমাদেরটি ছিল ৭নং গ্র"প। জুন-জুলাইয়ের দিকে গ্র"পটি গঠন করা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমরা প্রথম ঢাকায় ঢুকি। আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল ভারতে। জুনে আমি ঢাকায় আসি। সরাসরি অস্ত্র ট্রেনিংয়ের আগে ইঞ্জিনিয়ার সিরাজের নেতৃত্বে ঢাকায় একটি গ্রেনেড অপারেশনের গ্র"প পাঠানো হয়েছিল। সেই অপারেশনে আমি গুলশান অ্যাম্বাসিতে গ্রেনেড চার্জ করি। গ্রেনেড চার্জ করার পর আমাকে প্রশিক্ষণ শিবির মেলাঘরে নিয়ে যায়। প্রতিনিয়তই আমরা ঢাকায় আসা-যাওয়া করতাম। এর মধ্যেই আমাদের অপারেশনগুলো হতো। আমাদের নিজস্ব নৌকা ছিল। বর্ষার সময় আমরা নৌকায় আসা-যাওয়া করতাম। রূপগঞ্জ তখন অনেকটাই মুক্ত এলাকা। সেখানে আমরা অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতাম। রূপগঞ্জ থেকে আমরা শহর এড়িয়ে আমাদের গ্রাম ভাটারা আসতাম। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢুকে রেকি করতাম বা অপারেশনগুলো পরিচালনা করতাম। ১৫ তারিখ রাতে আমি ঘোড়াশাল কালীগঞ্জে ছিলাম। কালীগঞ্জে মামার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি রূপগঞ্জ থেকে হেঁটে আসি। ১৫ তারিখ রাতেই শোনা যাচ্ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী আÍসমর্পণ করবে। ১৬ তারিখ বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে মামার সঙ্গে আমি গল্প করছিলাম। এমন সময় আমি পাকিস্তানি বাহিনীর আÍসমর্পণের খবর পাই। হেলিকপ্টারে ছাড়া লিফলেটের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর আÍসমর্পণের খবর জানতে পারি। সেই সন্ধ্যারাতেই মামাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি ঢাকার দিকে রওনা হই। ১৭ তারিখ সকাল ৭-৮টার দিকে আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করি। আসার সময় দেখলাম সব মানুষ আনন্দে আÍহারা। আনন্দ উদযাপন করতে গিয়েই অনেক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনে আহত হয়েছে। আমি ক্যান্টনমেন্টে এসে দেখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অস্ত্র পড়ে আছে। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করি। চার-পাঁচটি গরুর গাড়ি ভর্তি অস্ত্র আমি আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমাদানের দিন দুই ট্রাক অস্ত্র আমি জমা দেই। শহরের সব মানুষের চোখ-মুখে ছিল মুক্তির আনন্দ। মানুষের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালে আমি ছিলাম স্টাফ ওয়েলফেয়ার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। কম বয়স সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। যুদ্ধ করি ২নং সেক্টরের অধীনে। 'ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প' নামে একটি গেরিলা গ্র"পের সদস্য হিসেবে আমি ঢাকায় পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি।
ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রাণ বিসর্জন, নারীর সম্ভ্রমহানি আর বিপুল রক্তক্ষয়ের পর এসেছিল এই স্বাধীনতা, বিজয়। বিশ্বের কোনো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে কি না, জানি না। আমরা গর্বিত জাতি। বিশ্বের প্রশিক্ষিত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে আমরা হারিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু এজন্য আমাদের অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে। বাঙালির এই বিজয়গাথা বিশ্বের ইতিহাসে অন্য রকমভাবে স্বীকৃত। যদি বলি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশের স্বাধীনতার প্রাক-প্রস্তুতি, তাহলে ভুল হবে কি? স্বাধীনতাহীনতায় কেউ যে বাঁচতে চায় না, যুগে যুগে বাঙালি জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। বাঙালির গৌরবগাথা বিশ্ব-ইতিহাসে অন্য রকমভাবে স্বীকৃতও। স্বাধীন-সার্বভৌম স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়েই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল। সেই ডাকে মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে। আমাদের স্বাধীনতা কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের ফল নয়। বাঙালির তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ প্রত্যয় বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে দেশটির জš§ দেয়। স্বতন্ত্র মানচিত্র নিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের পরিচিতি এক অনন্য ভাস্বর রূপে প্রস্ফুটিত।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। যুদ্ধ দিনের কিছু কথা আজ লিখছি। মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশনটিও পরিচালিত হয়েছিল ডিসেম্বর মাসেই। শুধু সম্মুখসমরে নয়, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও যে পাক হায়েনারা পরাজিত হয়েছেÑএটি পৃথিবীকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এ অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। আমার আক্রমণে মোনায়েম খানের মৃত্যুর পর অনেকের কাছে এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানিদের পরাজয় সময়ের ব্যাপারমাত্র। আমরা 'ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প' পাকিস্তানি মিলিটারির অ্যামবুশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যখন আবার মেলাঘরে ফিরে যাই, তখন আমাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর হায়দার সামরিক কায়দায় আমাদের বললেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প যেহেতু অ্যামবুশে পড়েছে, সুতরাং তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। তাই তাদের দ্বারা গেরিলা অপারেশন অথবা সম্মুুখসমর সম্ভব নয়। তাদের দিয়ে আর্মস-অ্যামিউনেশন বহন করা ছাড়া আর কোনো কাজ করানো যাবে না। এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আমাদের মধ্যে দারুণ হতাশার সৃষ্টি করে। আমরা মনে খুব কষ্ট পাই। ট্রেনিং শেষে প্রায় প্রতিদিন আমরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। একদিন তিনি ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তোমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী? বললাম, স্যার আমাদের গেরিলা যুদ্ধে পাঠান। তিনি বললেন, তোদের গেরিলা যুদ্ধে পাঠিয়ে কী হবে? তোরা তো মানসিকভাবে পরাস্ত। আমরা বললাম, না স্যার, আমরা মানসিকভাবে পরাস্ত হইনি। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বল, কাকে মারতে পারবি? নানা কথার পর আমি বললাম, স্যার আপনিই বলেন, কাকে মারব? তিনি বললেন, মোনায়েম খানকে মারতে পারবি? তিনি তার প্রশ্ন শেষ করার আগেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মোনায়েম খানকে মারতে পারলে কী দেবেন? তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আমি আজই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"পকে পাঠিয়ে দেব। বনানী কবরস্থানে মোনায়েম খানের স্ত্রীর কবর অবস্থিত। সেখানেই গরু চরানোর সময় তার গরুর রাখাল মোখলেছুর রহমান ও শাহজাহানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিকল্পনা হয়। তার সাহায্যেই আমরা মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করি। সে এক বিশাল স্মৃতি।
মোনায়েম খানকে হত্যা করা হয়েছিল সন্ধ্যার সময়। সন্ধ্যায় যখন মোখলেছুর গরু নিয়ে বাসায় ফেরে, তখন আমরা তার সঙ্গে মোনায়েম খানের বাড়িতে ঢুকে কলার বাগানে লুকিয়ে থাকি। বাড়ির ভেতর ঢুকে সে মোনায়েম খানের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। তখন মোখলেছ এবং শাহজাহানকে আমরা সরে যেতে বলি। ওরা সরে গেলে আমরা অপারেশন পরিচালনার জন্য সামনের দিকে মার্চ করি। মোনায়েম খান তখন ড্রইংরুমে ছিল। ড্রইংরুম খোলা ছিল। রুমের ভেতর পশ্চিম দিকে মুখ করে সোফায় বসা ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন এবং তার জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল আর মাঝখানে মোনায়েম খান। সে সময় ইন্ডিয়ান স্টেনগানে আমরা ফায়ার ওপেন করি। কিন্তু তখন অস্ত্র আমাদের সঙ্গে বিট্রে করে। এসএমজি থেকে একটা বুলেট বের হওয়ার পর ফেঁসে যায়। চেম্বারে গিয়ে দ্বিতীয় বুলেট আটকে যায়, বুলেট আর বের হয়নি। পরে জানতে পারি, সেই একটি গুলিতেই মোনায়েম খান প্রাণ হারায়। তারপর আমরা ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করি। সেটিও বিস্ফোরিত হয়নি। আমরা দৌড়ে তার বাড়ির দেয়াল টপকে বনানী কবরস্থানে চলে যাই। সেখানে দেয়াল টপকানোর সময় আমার পকেটে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেডটা পড়ে যায়। আমরা বনানী লেকের দিকে চলে যাই। মোনায়েম খানের বাড়িতে বেলুচ রেজিমেন্টের যে এক প্লাটুন পুলিশ ছিল, তারা সবাই চোখ বুজে শুয়ে উপরের দিকে আড়াল দিয়ে সিগারেট টানছিল। আমরা চলে যাওয়ার পর তারা আকাশের দিকে ফায়ারিং শুরু করে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে। তাদের ফায়ারিংয়ে নিউ ইয়ার উৎসবের আতশবাজির মতো আলোকিত হয়ে গিয়েছিল ঢাকার আকাশ। চারদিকে যেমন ছিল গুলির শব্দ, তেমনি আকাশে ছিল আলোর ঝলকানি। তখন যেন শুধু গুলির শব্দই সব দখল করে নিয়েছিল।
অপারেশন শেষ করে আসার সময় আমার ভাতিজা ইস াফিল খন্দকারের (এখন উপ-সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ) দোকানের পাশে এসে দরজা নক করে আমি পানি পান করতে চাইলে তিনি আমাকে পানি দেন। এরপর এয়ার ফোর্সের সার্জেন্ট আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের কাছে স্টেন দেয়ার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম, মোনায়েম খানের সেই দু'জন কর্মচারী মোখলেছুর ও শাহজাহান, আনোয়ার হোসেন বীরপ্রতীক, আমার বাবা, মা সবাই আমার চারপাশে বসা। তারা আমাকে রূপগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য বললেও আমি যেতে রাজি হলাম না। আমি বাড়িতেই থাকতে চাইলাম। বাংলা ঘরে আমি শুয়ে ছিলাম। সকালবেলা আমার দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে? আমার জ্যাঠা মালেক মাস্টারের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, রাতে আকাম করে এসে এখনো ঘরে শুয়ে আছো? আমি বললাম, কেন কী হয়েছে? তিনি বললেন, মোনায়েম খান মারা গেছে। মিলিটারি এসে এখন আমাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। মোনায়েম খানের মৃত্যুর কথা আমি জ্যাঠার কাছে শুনতে পাই।
তখন এটা বাইরের কেউ জানত না। যুদ্ধের পর পুরানা পল্টনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গড়ে ওঠে। সেখানে মেজর হায়দার আমাদের একশ' টাকা সম্মানী হিসেবে দেন। সে অনুষ্ঠানে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায়। তিনি আমাকে জানান, পুরস্কারের তালিকায় আমার নাম আছে। পরে পত্রিকায় দেখলাম বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকায় আমার নাম আছে। এরপর বিষয়টি মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তখন থেকেই মানুষ ঘটনাটি জানতে পারে। প্রত্যেকটা সেক্টরেই এরিয়াভিত্তিক একেকটি গেরিলা গ্র"প অপারেশনে পাঠানো হতো। আমাদের পাঠানো হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্র"প নাম দিয়ে। গ্র"পের সদস্যরা ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা। আমাদের গ্র"পের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৩ জন। আমাদের গ্র"প কমান্ডার ছিলেন এমএ লতিফ। আমাদের অপারেশন করতে হতো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়, বনানী ও গুলশানে। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরের আমাদেরটি ছিল ৭নং গ্র"প। জুন-জুলাইয়ের দিকে গ্র"পটি গঠন করা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমরা প্রথম ঢাকায় ঢুকি। আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল ভারতে। জুনে আমি ঢাকায় আসি। সরাসরি অস্ত্র ট্রেনিংয়ের আগে ইঞ্জিনিয়ার সিরাজের নেতৃত্বে ঢাকায় একটি গ্রেনেড অপারেশনের গ্র"প পাঠানো হয়েছিল। সেই অপারেশনে আমি গুলশান অ্যাম্বাসিতে গ্রেনেড চার্জ করি। গ্রেনেড চার্জ করার পর আমাকে প্রশিক্ষণ শিবির মেলাঘরে নিয়ে যায়। প্রতিনিয়তই আমরা ঢাকায় আসা-যাওয়া করতাম। এর মধ্যেই আমাদের অপারেশনগুলো হতো। আমাদের নিজস্ব নৌকা ছিল। বর্ষার সময় আমরা নৌকায় আসা-যাওয়া করতাম। রূপগঞ্জ তখন অনেকটাই মুক্ত এলাকা। সেখানে আমরা অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতাম। রূপগঞ্জ থেকে আমরা শহর এড়িয়ে আমাদের গ্রাম ভাটারা আসতাম। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢুকে রেকি করতাম বা অপারেশনগুলো পরিচালনা করতাম। ১৫ তারিখ রাতে আমি ঘোড়াশাল কালীগঞ্জে ছিলাম। কালীগঞ্জে মামার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি রূপগঞ্জ থেকে হেঁটে আসি। ১৫ তারিখ রাতেই শোনা যাচ্ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী আÍসমর্পণ করবে। ১৬ তারিখ বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে মামার সঙ্গে আমি গল্প করছিলাম। এমন সময় আমি পাকিস্তানি বাহিনীর আÍসমর্পণের খবর পাই। হেলিকপ্টারে ছাড়া লিফলেটের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর আÍসমর্পণের খবর জানতে পারি। সেই সন্ধ্যারাতেই মামাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি ঢাকার দিকে রওনা হই। ১৭ তারিখ সকাল ৭-৮টার দিকে আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করি। আসার সময় দেখলাম সব মানুষ আনন্দে আÍহারা। আনন্দ উদযাপন করতে গিয়েই অনেক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনে আহত হয়েছে। আমি ক্যান্টনমেন্টে এসে দেখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অস্ত্র পড়ে আছে। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করি। চার-পাঁচটি গরুর গাড়ি ভর্তি অস্ত্র আমি আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমাদানের দিন দুই ট্রাক অস্ত্র আমি জমা দেই। শহরের সব মানুষের চোখ-মুখে ছিল মুক্তির আনন্দ। মানুষের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা
রাজাকার নামাঃ গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান
Monem Khan . . . collaborator
http://opinion.bdnews24.com/2017/01/15/monem-khan-collaborator-martyr/
মোনায়েম খান শহীদ! | 174869 | Bangladesh Pratidin
Oct 6, 2016 - ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন মোনায়েম খান। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন হয়। মোনায়েম.
অপারেশন মোনায়েম খান প্রসঙ্গে মোজাম্মেল হক বীর প্রতীক
এক গুলিতেই সফল
Dec 17, 2014 - 'একাত্তরের ১৪ অক্টোবর ভোরে বাড়ির বাংলোঘরে শুয়ে আছি। মালেক চাচা (ভাটারার আবদুল মালেক মাস্টার) জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। দরজা খুলতেই বললেন, 'রাইতে আকাম কইরা শুইয়া আছ। মোনায়েম খান মারা গেছে। মিলিটারি বাড়িত আইল, তাড়াতাড়ি বাড়িত থেইকা বাইর-হ।' তখনই নিশ্চিত হলাম আমার গুলিতেই মারা গেছেন পূর্ব ...
নিহত 'জঙ্গিদের' মধ্যে মোনায়েম খানের নাতি - bdnews24.com
Jul 28, 2016 - আজীবন পাকিস্তানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী মোনায়েম খানের এক নাতিকে পাওয়া গেছে ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের ... তাজ মঞ্জিলে অভিযানে নিহত নয় যুবকের মধ্যে আকিফুজ্জামান খান (২৪) মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত মোনায়েমখানের নাতি বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান ...
__._,_.___