স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নে এর বিরোধিতা করেও যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। একের পর এক মৃত্যুদ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে এ কলঙ্ক মোচন করছে জাতি। গত তিন বছরে কুখ্যাত ৬ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ চার দশকের বিচারহীনতা থেকে মুক্তির দিন হিসেবে মনে রাখবে। সেই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নাম। একাত্তরে নৃশংসতার জন্য 'কসাই কাদের' নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলে তরুণ প্রজন্ম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের আন্দোলনের চাপে দুইপক্ষকে আপীলের সমান সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা হয়। তারপর সর্বোচ্চ আদালতে আপীল এবং সেখানে ফাঁসির রায়। এরপর একে একে মানবতাবিরোধী অপরাধে ছয়জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- ॥ ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শুরু হয় ওই বছরের ২১ জুলাই। ২০১২ সালের ২৮ মে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩ জুলাই থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। এই যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের মধ্যে প্রচ- প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন বিকেল থেকে জড়ো হতে থাকে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে। প্রতিবাদী মানুষগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে তোলে প্রতিবাদ-গণজাগরণ মঞ্চ।
গণদাবির একপর্যায়ে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) আইন সংশোধন করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন বিল-২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। সংশোধনের ফলে আসামিপক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষও রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সমান সুযোগ পায়। আগে আইনে দ-াদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল করার সুযোগ ছিল না। আইন সংশোধনের পর ৩ মার্চ কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন ৪ মার্চ আপীল করেন কাদের মোল্লা। এরপর ১ এপ্রিল আপীলের শুনানি শুরুর ৫৫ দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা এক মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় এটি প্রথম কার্যকর হওয়া দ-।
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- ॥ একাত্তরে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে ১৪৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করে আসামিপক্ষ। ২০১৪ সালের ৩ নবেম্বর সোহাগপুর হত্যাকা-ের দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে আপীল বিভাগ। এরপর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয়।
সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসি ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে পাশাপাশি দুটি মঞ্চে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২২ নবেম্বর ২০১৫, শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের এই দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদ- দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে আনা বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণসহ সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ২০১৫ সালের ১৬ জুন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখে আপীল বিভাগ। অন্যদিকে চলতি বছরের ২৯ জুলাই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখে আপীল বিভাগ। মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে কুখ্যাত এই দুই যুদ্ধাপরাধী নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। তবে রাষ্ট্রপতি ওই আবেদন দুটি খারিজ করে দেন।
মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- ॥ মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির ও একাত্তরের বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় ১১ মে, ২০১৬। রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এ দ- কার্যকর করা হয়। আপীল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে বলা হয়েছে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের নক্সাকার। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, নিজামীকে এ দেশের মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ নারীকে অসম্মান করা হয়েছে। এটা জাতির জন্য লজ্জা, অবমাননা। এর আগে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ হয়েছে।
মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ॥ সর্বশেষ গত শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে কার্যকর হলো 'চট্টগ্রামের জল্লাদ' বলে কুখ্যাত মীর কাশেম আলীর ফাঁসি। জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। মীর কাশেমের মৃত্যুদ- হয়েছে দুটি অভিযোগে।
- See more at: https://www.dailyjanakantha.http://www.csbnews24.com/
__._,_.___