বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মতিঝিলের শাপলা চত্বরের হেফাজতীদের বিতাড়ন অভিযানে কোন লাশ গুম করার ঘটনা ঘটেনি। সেখানে পলিথিনে মোড়ানো চারটি লাশ পাওয়া যায়। হেফাজতীরা একজন পুলিশ অফিসারকে কুপিয়ে হত্যা করে। অন্যদিকে হেফাজতীরা বাংলাদেশ ব্যাংক লুট ও সচিবালয়ে আক্রমণ করত বলে আমাদের কাছে নিশ্চিত খবর ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ র্যাব ও বিজিবি প্রতিনিধিদের নিয়ে এক আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, যদি কেউ নিখোঁজ থাকেন তাঁর পক্ষ থেকে যেন নামঠিকানাসহ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
অন্যদিকে শাপলা চত্বরে যে হাজার হাজার লাশ গুম করা হয়েছে, পিলখানায় সেসব রাখা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ গুজবের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিজিবিপ্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, যে কেউ এসে প্রমাণ করুক কোথায় এ লাশ আছে। তিনি একটি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাতকারে আরও বলেন, পিলখানায় এখন বাইরের শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের কাছেও শুনতে পারেন। এ ছাড়া র্যাবের লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাতকারে স্পষ্ট করে বলেন, ওই অপারেশনে একজন পুলিশ ছাড়া কেউ মারা যায়নি। প্রথম আলোর সাংবাদিক কামরুল আহসান সেদিন পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি টেলিভিশন টক শোতে বলেন, সবকিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। সেখানে লাশ সরানোর কোন উপায় ছিল না। উল্লেখ্য, শাপলা চত্ব¡র থেকে সেদিন ভোররাতে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির নেতৃত্বে হেফাজতীদের বিতাড়নের পর নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপিসহ বিরোধী দল ও কিছু সামাজিক মাধ্যম অভিযানের একদিন পর থেকে প্রচার করছে শাপলা চত্বরে অসংখ্য মানুষ হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দল কোন তথ্যসূত্র ছাড়া এমনকি বিদেশী প্রচারমাধ্যমের নাম উল্লেখ করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাশ গুমের কথা বলছে। কিছু সামাজিক গণমাধ্যম মিয়ানমার, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নিহতদের ছবি কম্পিউটার ফটোশপের মাধ্যমে শাপলা চত্বরে নিহতদের ছবি হিসেবে প্রচার করছে, যা নিয়ে দেশে কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভ্রান্তির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেছেন, শাপলা চত্বরে রাতের বেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক, মতিঝিলে অবস্থিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলা, লুট করে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে হামলা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ জন্য রাতের বেলায় শাপলা চত্বরে হেফজতী সমাবেশে অভিযান চালানো হয়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে অভিযানে হাজার হাজার ব্যক্তি নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যদি এত লোক মারা যেত তাহলে নিহত ব্যক্তির স্বজনরা কোথায়? সাভারের ভবনধসের পর থেকে হাজার হাজার স্বজন ও প্রিয়জন নিহতদের সন্ধানে গেছেন। শাপলা চত্বরের সমাবেশে অভিযানের ঘটনায় নিহতের দাবি নিয়ে হাজার হাজার স্বজন প্রিয়জন আসেননি কেন? মৃতদেহ গুম করা অসম্ভব। এটা ডাহা মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে। বিরোধী দলের উদ্দেশে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, হাজার হাজার মৃতদেহের তালিকা আপনারা কোথায় পেলেন? আপনাদের কাছে তালিকা থাকলে আমাদের কাছে দেন। দুটো টেলিভিশন সরাসরি অভিযানটি সম্প্রচার করেছে। সাংবাদিকরা অভিযানের সময় উপস্থিত ছিলেন। ক্যামেরাম্যানরা ছিলেন। এতে লুকোচুরির কিছু নেই। আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী এই সঙ্কটকালে রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আপনারা এর মূল্যায়ন করুন। বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন এসব কথা বলেছেন তিনি।
ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেছেন, এখন আমরা অগ্রসর (অ্যাডভান্সড) সময়ে বসবাস করি। এই যুগে মৃতদেহ গুম করা অসম্ভব। মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে। কম্পিউটার ফটোশপ করে আমাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। শাপলা চত্বর থেকে আমরা সাতটি লাশ উদ্ধার করেছি। আমাদের এক সহকর্মীকে (পুলিশ সদস্য) হেফাজতীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশ সদস্যকে খুন করে তার অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। উদ্ধার করা লাশের মধ্যে চারটি লাশ মঞ্চের নিচে কাফনে মোড়ানো ছিল। শাপলা চত্বরের অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অভিযানের সময়ে পূর্ব ও দক্ষিণ অংশ খোলা রাখি যাতে হেফাজতীরা বের হয়ে যেতে পারে। এই অভিযানের সময়ে ওয়াটার ক্যানন, সাউন্ড গ্রেনেড, স্মোক গ্রেনেড ব্যবহার করেছি। ওয়ার্ল্ড ক্লাস লজিস্টিক ব্যবহার করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল জিরো ক্যাজুয়ালিটি। আমরা মোটামুটি সফল হয়েছি। অভিযানে ম্যাক্সিমাম অফিসার ব্যবহার করেছি। এটা ছিল অফিসার বেজড অভিযান। সফলভাবে অভিযান শেষ করেছি। গত ৫ মে রাত দুটায় অপরাশেন শুরু করেছি। মাত্র ১০ মিনিটে ঈর্ষণীয় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অভিযান শেষ করেছি।
মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান, বিজিবির ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল এহিয়া আজম, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল। শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের সরাতে ৫ মে রাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির অভিযান সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানাতে এবং বিরোধী দলের লাশ গম গুজবের মিথ্যা প্রচারেরর ব্যাপারে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেছেন, দরিদ্র, দৈন্য সামাজিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে সমাবেশে শিশুকিশোরদের ভুল বুঝিয়ে শাপলা চত্বরের সমাবেশে আনা হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, হেফাজতের পরিকল্পনা ছিল ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লুট ও সচিবালয়ে আক্রমণ করা। রাতে যদি তাদের শাপলা চত্বর থেকে সরানো না হতো এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত থাকতে দেয়া হতো তাহলে তারা যা ইচ্ছা তাই করত। একটি দলের পক্ষ থেকে ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় নাশকতা চালানোর জন্য নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়। অভিযানের পর হেফাজতের মঞ্চের কাছে চারটি লাশ কাপনের কাপড়ের ও পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় এবং বিভিন্ন স্থানে আরও তিনটি লাশ পাওয়া যায়। এছাড়া হেফাজত কর্মীরা এক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করে। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ চলাকালে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় তাতে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক বাড়তে থাকে।
নাশকতার তথ্য থাকার পরও হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করতে দেয়া হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা দোয়া করে চলে যাবে। এ ছাড়া গোয়েন্দা তথ্য থাকলেও তা সুনির্দিষ্ট ছিল না। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি হচ্ছে, ধর্মীয় নেতার কথাকে আমরা গুরুত্ব দেই ও বিশ্বাস করি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তারা ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করবে না। হেফাজত প্রতিনিধিরা তখন বলেছিল- শফী হুজুর দোয়া করে সমাবেশ শেষ করে দেবেন। কিন্তু তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তারা তা রক্ষা করেনি।
পুলিশ কমিশনার বলেন, এই অভিযানটির নাম ছিল 'অপারেশন শাপলা।' নাশকতা ও ব্যাপক মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ থেকে জনগণকে রক্ষা করতেই ওই অভিযান চালানো হয়।
এই অভিযানে কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। সারা বিশ্বে পুলিশ যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে এমন অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কোন প্রাণহানি ছাড়া হেফাজতকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়া। আমরা এতে সফল হয়েছি।
যৌথ বাহিনীর দলটি শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া নাশকতাকারীদের সরিয়ে দেয়ার জন্যই 'অপারেশন শাপলা' নামে এ অভিযান চালায়। তবে ওই দিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্যসহ মোট ১১ জন নিহত হয় বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। তাদের মধ্যে অভিযানের সময় চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় শাপলা চত্বরে হেফাজতের মঞ্চের কাছ থেকে। তারা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ছিল। এ ছাড়া ওই এলাকা থেকে আরও ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়- যাদের কেউই অভিযানে মারা যায়নি বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। রবিবার রাতের অভিযান নিয়ে নানা গুজব শুরু হওয়ার দুদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ।
নাশকতার তথ্য থাকার পরও হেফাজতে ইসলামকে কেন সমাবেশ করতে দেয়া হলো- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বেনজীর আহমেদ বলেন, হেফাজতে ইসলাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা দোয়া করে চলে যাবে। দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী সে প্রতিশ্রুতিতে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। তবে তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে- যা কোনভাবেই কাম্য ছিল না। ধ্বংসযজ্ঞের পর দায়ের করা মামলাগুলোতে হেফাজতের প্রধান আল্লামা আহমাদ শফীকে আসামি না করার বিষয়ে কমিশনার বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলব না। তবে তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আসামি করা হবে।