বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০১৩, ২৬ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না
মুনতাসীর মামুন
॥ প্রথম কিস্তি ॥
৩ মে শাপলা চত্বরের জনসভায় শিফন পরিহিত খালেদা জিয়ার হাসি ও ঠাট্টা করার ভঙ্গিতে বক্তৃতা শেষ করায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তার হাসি ও ঠাট্টা জীবননাশী। এমনিতে শুধু আমরা নই, মধ্যবিত্ত ও রাজনীতি বিমুখ অনেকে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ঘোষণায়। বিএনপি জামায়াত ঘেঁষা বা নিরপেক্ষ অনেক বিজ্ঞ, টিভিতে এই তত্ত্ব দিচ্ছিলেন যে, এতদিনে একটি তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হলো এবং তা হলো হেফাজতে ইসলাম। তাদের খুশির কারণ, হেফাজত জামায়াত-বিএনপির অনুগত।
আমরা ঘরপোড়া গরু। ৩ মে খালেদা জিয়া যখন চকচকে পোশাক-আশাকে প্রফুল্ল চিত্তে জনসভায় এলেন তখনই শঙ্কিত বোধ করলাম। এর আগে তার সহযোগী শক্তি হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করেছিল, ৬ তারিখে নতুন সরকার গঠন করবে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী, হাটহাজারী মাদ্রাসার আহমাদ শফীকে। হাসিনাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে হানাদারদের সহযোগীর কাছে আবার আত্মসমর্পণ করতে হবে- এটি অশেষ তৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল খালেদার কাছে। তার প্রয়াত স্বামী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য। আর তিনি প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে। এটি তার জন্য আরও আনন্দের, কারণ, ১৯৭২ সালে তাকে যেতে হয়েছিল মাথা নিচু করে বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে সাংসারিক সমস্যা মেটানোর জন্য।
যাক, খালেদা জিয়া জনাব শফীর অনুচরদের সে ঘোষণা মনে রেখেছিলেন। তাই সমবেত সমর্থকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন কীনা। তিনি, খালেদা একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাই হেফাজতের নামটি পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তার সহকারী একজন যিনি এখন নেতা তবে প্রাক্তন লাঠিয়াল ও হাইজ্যাকার, তাকে হেফাজতের নাম মনে করিয়ে দিলেন এবং তারপর খালেদা ঘোষণা করলেন, যেহেতু হেফাজত সমাবেশ করবে সেহেতু সরকারকে তাদের দাবি মেনে নেয়ার ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেয়া হলো।
আমরা অনেকেই তখন শঙ্কিত। খালেদার ঘোষণার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি ও আমার বন্ধুরা সেলফোন কোম্পানির খাতে মোটা টাকা গচ্চা দিলাম। আমরা অনুমান করছিলাম, হেফাজত যে কোনভাবে ঢাকায় ঢুকবে এবং অবস্থান নেবে। ৫ তারিখ সন্ধ্যায় ৪৮ ঘণ্টা পুরো হলে বিএনপি-জামায়াত (হেফাজতেও তারা আছে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পরে) মিলিত হবে হেফাজতীদের সঙ্গে। তাদের মিলিত শক্তি পতন ঘটাবে 'নাস্তিক' হাসিনার। বিজয়ী হবেন শফী-খালেদার নতুন প্যানেল। দৈনিক জনকণ্ঠে ওইদিনই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে হেফাজতী নেতাদের আলাপ-সালাপ হয়েছে এবং হেফাজতীদের কোন্ কোন্ মন্ত্রণালয় দেয়া হবে সে সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। খালেদার মুখে হাসি থাকবে না তো আমাদের থাকবে!
সেদিন রাতে বহুদিন পর খালেদা চমৎকার ঘুম ঘুমিয়েছেন বলে অনেকের অনুমান। আমাদের কেটেছে বিনিদ্র রজনী। সকালে তাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গালেন আমার বন্ধু শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার সবসময় বিপ্লবী উত্তেজনায় আক্রান্ত এবং প্রায় সময়ই এ কারণে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন এবং তার রাতের চিন্তা ও তত্ত্ব সকালে আমাদের কাউকে না কাউকে শুনতে হয়। খুব সকালে ফোন করলে ধরে নিতে হবে, বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সারারাত জেগেছিলেন। দেরিতে ফোন করলে বুঝতে হবে, বয়সের কারণে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমরাই শাহরিয়ারকে ফোনের কারণ, তার তুলনায় আমি খানিকটা ভীতু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লন্ডনের ভিসা আছে? শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা আছে, টিকেট নেই। আমি জানালাম, দু'টার কোনটিই আমার নেই। কী হবে? উদ্বেগের হেতু হিসেবে জানালাম, ৬ তারিখ শফী-খালেদার সরকার হবে। আমাদের তো বাঁচার উপায় নেই। আর ১৪ দলের নেতারা তো সবার আগে পালাবে ২০০১ বা ২০০৬-এর মতো। শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা টিকেট থাকলেও তিনি ১৪ দলের নেতাদের মতো আচরণ করবেন না। তিনি জনগণের সঙ্গেই থাকবেন। তাছাড়া এ সরকারের দুঃসময়ে পাশে থাকা নৈতিক কর্র্তব্য। বুঝলাম, তার সঙ্গে আলোচনা চালানো বৃথা। বাস্তব বোঝা তার পক্ষে কঠিন। ১৪ দল বা নির্দিষ্টভাবে আওয়ামী লীগ যে অনেক আগে থেকেই কোটারির বাইরের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে এবং পরামর্শ, সাহায্য-সহায়তা যে অনাকাক্সিক্ষত এটি বোঝার ক্ষমতা আমার বন্ধুটি ক্রমেই হারাচ্ছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য, এটিও বলি তার কথা কখনও কখনও আবার ঠিকও হয়ে যায়।
আসলে, সব আমলেই আমাদের অবস্থা খারাপ। আমরা বলতে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতিকর্মী যারা মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু আমলে, সম্পত্তি হারানো থেকে মাঝে মাঝে ধাওয়া খাওয়া ছিল আমাদের অনেকের ললাট লিপি। অন্তত আমাদের পরিবারের। জাতীয় পার্টির আমলে প্রায় সময়ই দৌড়াতে হয়েছে, লাঠির বাড়িও পড়েছে পিঠে, হাতে। স্বৈরাচারী ও ব্যভিচারী জেনারেল এরশাদ আমলের একটি দিনের কথা মনে পড়লে দুঃখের মধ্যেও হাসি পায়। অধিক ওজনের জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী আলী যাকের হাঁসফাঁস করে দৌড়াচ্ছেন, পিঠে এরই মধ্যে পুলিশের লাঠির একটি বাড়ি খেয়েছেন। তার পাশে থাকা শিল্পী হাশেম খান ও তার পিছে থাকা আমি হাতে লাঠির বাড়ির জ্বালা সামলাতে সামলাতে দৌড়াচ্ছি। ওই আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রুমে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে মুরতাদ ঘোষিত হই এবং উদ্যমী ছাত্রদল সমর্থকের পিস্তলের গুলি ও আরেকবার তাদের ছোড়া ভারি পাথর থেকে রক্ষা পাই। দ্বিতীয় আমলে অনেকে জেলে যাই, শাহরিয়ার দু'বার। আওয়ামী লীগ আমরা যাই বলি বা যাই করি তাই ধরে নেয়া হয় সরকার বিরোধিতা হিসেবে এবং ১/১১-এর আগে থেকে যারা শেখ হাসিনার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লড়েছেন তাদের সযতনে পরিহার করা হয়। আমি যে শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত তার কথা বলি। গত কয়েক বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে (শিক্ষকদের সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত পদ) প্রায় ক্ষেত্রে বেছে বেছে তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে যারা সবসময় শেখ হাসিনার ব্যাপারে নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন অথবা বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতাও এমন আহামরি কিছু নয়। তবে, মুক্তকণ্ঠে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, শেখ হাসিনার আমলেই আমরা নিরাপদ মনে করি। ৬ তারিখের নতুন সরকার নিয়ে তাই ছিল শঙ্কা। কারণ, ইতোমধ্যে আমাদের অনেককে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতায় এলে তারা মুরতাদদের ক্ষমা করবে এমন ভাবা বোকামি। তবে একজন মুসলমান হিসেবে অন্তিমে নিয়তিবাদী হয়ে বসে থাকি।
আমাদের শঙ্কার, শুধু আমাদের নয় দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন ক্রমাগত সরকারের নতজানু নীতিতে হতাশা ও বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সরকার নানা কারণে নানা নীতি পারে, কিন্তু, তাই বলে দলও? এ কারণে, বঙ্গবন্ধু দল ও সরকার প্রধান ভিন্ন রেখেছিলেন অন্তত কাগজপত্রে ও প্রকাশ্যে। সরকারপ্রধান ও তার পার্শ্বচররা বার বার হেফাজতের মধ্যে জামায়াত দেখছিলেন। সেটি সত্য কিন্তু হেফাজত যে স্বেচ্ছায় জামায়াতী হয়ে যাচ্ছিল তাও তো সত্য। সরকার প্রধানের মিনতি দেখে এ অনুমান দেখা দিয়েছিল যে, ১৪ দল প্রধান ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। তবে, বিএনপিরা নিশ্চিত ছিল, সরকার পতন হচ্ছেই, হেফাজতীরাও। ৫ মে টাকা না পাওয়া হেফাজত কর্মীরা লং মার্চ করে কমিউনিস্টদের মতো জেহাদের বা সরকার উৎখাতের বাসনায় শহরে ঢুকছিল তখন নাকি বিএনপি নেতাদের অনেকে টিপটপ থেকে সদ্য ইস্ত্রি স্যুট আনতে পাঠিয়েছিলেন। টাকা খাওয়া পান খাওয়া ঠোঁট লাল করা হেফাজতী নেতারা এর আগে রোদ-বৃষ্টিতে লং মার্চ করার ভয়ে দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আহমাদ শফীকে নিয়ে প্লেনে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। অবশ্য এর কারণও ছিল, সরকার গঠনে তারা দর কষাকষি করেছিলেন। আহমাদ শফীকে প্রেসিডেন্ট করার শর্ত নাকি মেনে নেয়া হয়। যে কারণে, দুপুরে, জানিয়েছেন আমাকে যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, হেফাজতীরা তার ও অন্য আরও গোটা দশেক গাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয়ার সময় গ্যাংনাম স্টাইলে নাচতে নাচতে উল্লসিত হয়ে সেøাগান দেয়- 'রাষ্ট্রপতি হবে কে, আহমাদ শফী আবার কে?'। 'শেখ হাসিনার গদিতে আগুন দে, পুড়িয়ে দে', 'আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।' রফিকুল ইসলাম ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে গাড়িটি কিনেছিলেন এবং হেফাজতীদের সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী অরাজনৈতিক ও ঈমানী শান্ত মুসলমান ভেবেছিলেন। গাড়ি পুড়তে দেখে তা মনে করে অনুশোচনায় ভুগছিলেন। হেফাজতী নেতারাও নাকি লন্ড্রি থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে এনেছিলেন এবং ক্ষমতা নেয়ার সময় টুপি পরবেন না পাগড়ি পরবেন এ নিয়ে নাকি মৃদু দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিফলন দেখি ৫ তারিখে হেফাজতের জনসভায় যেখানে কিছু নেতার মাথায় ছিল টুপি, কিছু নেতার মাথায় পাগড়ি।
(চলবে)
৩ মে শাপলা চত্বরের জনসভায় শিফন পরিহিত খালেদা জিয়ার হাসি ও ঠাট্টা করার ভঙ্গিতে বক্তৃতা শেষ করায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তার হাসি ও ঠাট্টা জীবননাশী। এমনিতে শুধু আমরা নই, মধ্যবিত্ত ও রাজনীতি বিমুখ অনেকে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ ঘোষণায়। বিএনপি জামায়াত ঘেঁষা বা নিরপেক্ষ অনেক বিজ্ঞ, টিভিতে এই তত্ত্ব দিচ্ছিলেন যে, এতদিনে একটি তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হলো এবং তা হলো হেফাজতে ইসলাম। তাদের খুশির কারণ, হেফাজত জামায়াত-বিএনপির অনুগত।
আমরা ঘরপোড়া গরু। ৩ মে খালেদা জিয়া যখন চকচকে পোশাক-আশাকে প্রফুল্ল চিত্তে জনসভায় এলেন তখনই শঙ্কিত বোধ করলাম। এর আগে তার সহযোগী শক্তি হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করেছিল, ৬ তারিখে নতুন সরকার গঠন করবে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী, হাটহাজারী মাদ্রাসার আহমাদ শফীকে। হাসিনাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে হানাদারদের সহযোগীর কাছে আবার আত্মসমর্পণ করতে হবে- এটি অশেষ তৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল খালেদার কাছে। তার প্রয়াত স্বামী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য। আর তিনি প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে। এটি তার জন্য আরও আনন্দের, কারণ, ১৯৭২ সালে তাকে যেতে হয়েছিল মাথা নিচু করে বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে সাংসারিক সমস্যা মেটানোর জন্য।
যাক, খালেদা জিয়া জনাব শফীর অনুচরদের সে ঘোষণা মনে রেখেছিলেন। তাই সমবেত সমর্থকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন কীনা। তিনি, খালেদা একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাই হেফাজতের নামটি পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তার সহকারী একজন যিনি এখন নেতা তবে প্রাক্তন লাঠিয়াল ও হাইজ্যাকার, তাকে হেফাজতের নাম মনে করিয়ে দিলেন এবং তারপর খালেদা ঘোষণা করলেন, যেহেতু হেফাজত সমাবেশ করবে সেহেতু সরকারকে তাদের দাবি মেনে নেয়ার ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেয়া হলো।
আমরা অনেকেই তখন শঙ্কিত। খালেদার ঘোষণার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি ও আমার বন্ধুরা সেলফোন কোম্পানির খাতে মোটা টাকা গচ্চা দিলাম। আমরা অনুমান করছিলাম, হেফাজত যে কোনভাবে ঢাকায় ঢুকবে এবং অবস্থান নেবে। ৫ তারিখ সন্ধ্যায় ৪৮ ঘণ্টা পুরো হলে বিএনপি-জামায়াত (হেফাজতেও তারা আছে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পরে) মিলিত হবে হেফাজতীদের সঙ্গে। তাদের মিলিত শক্তি পতন ঘটাবে 'নাস্তিক' হাসিনার। বিজয়ী হবেন শফী-খালেদার নতুন প্যানেল। দৈনিক জনকণ্ঠে ওইদিনই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে হেফাজতী নেতাদের আলাপ-সালাপ হয়েছে এবং হেফাজতীদের কোন্ কোন্ মন্ত্রণালয় দেয়া হবে সে সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। খালেদার মুখে হাসি থাকবে না তো আমাদের থাকবে!
সেদিন রাতে বহুদিন পর খালেদা চমৎকার ঘুম ঘুমিয়েছেন বলে অনেকের অনুমান। আমাদের কেটেছে বিনিদ্র রজনী। সকালে তাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গালেন আমার বন্ধু শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার সবসময় বিপ্লবী উত্তেজনায় আক্রান্ত এবং প্রায় সময়ই এ কারণে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন এবং তার রাতের চিন্তা ও তত্ত্ব সকালে আমাদের কাউকে না কাউকে শুনতে হয়। খুব সকালে ফোন করলে ধরে নিতে হবে, বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সারারাত জেগেছিলেন। দেরিতে ফোন করলে বুঝতে হবে, বয়সের কারণে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমরাই শাহরিয়ারকে ফোনের কারণ, তার তুলনায় আমি খানিকটা ভীতু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লন্ডনের ভিসা আছে? শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা আছে, টিকেট নেই। আমি জানালাম, দু'টার কোনটিই আমার নেই। কী হবে? উদ্বেগের হেতু হিসেবে জানালাম, ৬ তারিখ শফী-খালেদার সরকার হবে। আমাদের তো বাঁচার উপায় নেই। আর ১৪ দলের নেতারা তো সবার আগে পালাবে ২০০১ বা ২০০৬-এর মতো। শাহরিয়ার জানালেন, ভিসা টিকেট থাকলেও তিনি ১৪ দলের নেতাদের মতো আচরণ করবেন না। তিনি জনগণের সঙ্গেই থাকবেন। তাছাড়া এ সরকারের দুঃসময়ে পাশে থাকা নৈতিক কর্র্তব্য। বুঝলাম, তার সঙ্গে আলোচনা চালানো বৃথা। বাস্তব বোঝা তার পক্ষে কঠিন। ১৪ দল বা নির্দিষ্টভাবে আওয়ামী লীগ যে অনেক আগে থেকেই কোটারির বাইরের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে এবং পরামর্শ, সাহায্য-সহায়তা যে অনাকাক্সিক্ষত এটি বোঝার ক্ষমতা আমার বন্ধুটি ক্রমেই হারাচ্ছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য, এটিও বলি তার কথা কখনও কখনও আবার ঠিকও হয়ে যায়।
আসলে, সব আমলেই আমাদের অবস্থা খারাপ। আমরা বলতে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতিকর্মী যারা মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু আমলে, সম্পত্তি হারানো থেকে মাঝে মাঝে ধাওয়া খাওয়া ছিল আমাদের অনেকের ললাট লিপি। অন্তত আমাদের পরিবারের। জাতীয় পার্টির আমলে প্রায় সময়ই দৌড়াতে হয়েছে, লাঠির বাড়িও পড়েছে পিঠে, হাতে। স্বৈরাচারী ও ব্যভিচারী জেনারেল এরশাদ আমলের একটি দিনের কথা মনে পড়লে দুঃখের মধ্যেও হাসি পায়। অধিক ওজনের জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী আলী যাকের হাঁসফাঁস করে দৌড়াচ্ছেন, পিঠে এরই মধ্যে পুলিশের লাঠির একটি বাড়ি খেয়েছেন। তার পাশে থাকা শিল্পী হাশেম খান ও তার পিছে থাকা আমি হাতে লাঠির বাড়ির জ্বালা সামলাতে সামলাতে দৌড়াচ্ছি। ওই আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রুমে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে মুরতাদ ঘোষিত হই এবং উদ্যমী ছাত্রদল সমর্থকের পিস্তলের গুলি ও আরেকবার তাদের ছোড়া ভারি পাথর থেকে রক্ষা পাই। দ্বিতীয় আমলে অনেকে জেলে যাই, শাহরিয়ার দু'বার। আওয়ামী লীগ আমরা যাই বলি বা যাই করি তাই ধরে নেয়া হয় সরকার বিরোধিতা হিসেবে এবং ১/১১-এর আগে থেকে যারা শেখ হাসিনার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লড়েছেন তাদের সযতনে পরিহার করা হয়। আমি যে শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত তার কথা বলি। গত কয়েক বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে (শিক্ষকদের সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত পদ) প্রায় ক্ষেত্রে বেছে বেছে তাদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে যারা সবসময় শেখ হাসিনার ব্যাপারে নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন অথবা বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতাও এমন আহামরি কিছু নয়। তবে, মুক্তকণ্ঠে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, শেখ হাসিনার আমলেই আমরা নিরাপদ মনে করি। ৬ তারিখের নতুন সরকার নিয়ে তাই ছিল শঙ্কা। কারণ, ইতোমধ্যে আমাদের অনেককে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতায় এলে তারা মুরতাদদের ক্ষমা করবে এমন ভাবা বোকামি। তবে একজন মুসলমান হিসেবে অন্তিমে নিয়তিবাদী হয়ে বসে থাকি।
আমাদের শঙ্কার, শুধু আমাদের নয় দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন ক্রমাগত সরকারের নতজানু নীতিতে হতাশা ও বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সরকার নানা কারণে নানা নীতি পারে, কিন্তু, তাই বলে দলও? এ কারণে, বঙ্গবন্ধু দল ও সরকার প্রধান ভিন্ন রেখেছিলেন অন্তত কাগজপত্রে ও প্রকাশ্যে। সরকারপ্রধান ও তার পার্শ্বচররা বার বার হেফাজতের মধ্যে জামায়াত দেখছিলেন। সেটি সত্য কিন্তু হেফাজত যে স্বেচ্ছায় জামায়াতী হয়ে যাচ্ছিল তাও তো সত্য। সরকার প্রধানের মিনতি দেখে এ অনুমান দেখা দিয়েছিল যে, ১৪ দল প্রধান ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। তবে, বিএনপিরা নিশ্চিত ছিল, সরকার পতন হচ্ছেই, হেফাজতীরাও। ৫ মে টাকা না পাওয়া হেফাজত কর্মীরা লং মার্চ করে কমিউনিস্টদের মতো জেহাদের বা সরকার উৎখাতের বাসনায় শহরে ঢুকছিল তখন নাকি বিএনপি নেতাদের অনেকে টিপটপ থেকে সদ্য ইস্ত্রি স্যুট আনতে পাঠিয়েছিলেন। টাকা খাওয়া পান খাওয়া ঠোঁট লাল করা হেফাজতী নেতারা এর আগে রোদ-বৃষ্টিতে লং মার্চ করার ভয়ে দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আহমাদ শফীকে নিয়ে প্লেনে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। অবশ্য এর কারণও ছিল, সরকার গঠনে তারা দর কষাকষি করেছিলেন। আহমাদ শফীকে প্রেসিডেন্ট করার শর্ত নাকি মেনে নেয়া হয়। যে কারণে, দুপুরে, জানিয়েছেন আমাকে যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, হেফাজতীরা তার ও অন্য আরও গোটা দশেক গাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেয়ার সময় গ্যাংনাম স্টাইলে নাচতে নাচতে উল্লসিত হয়ে সেøাগান দেয়- 'রাষ্ট্রপতি হবে কে, আহমাদ শফী আবার কে?'। 'শেখ হাসিনার গদিতে আগুন দে, পুড়িয়ে দে', 'আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।' রফিকুল ইসলাম ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে গাড়িটি কিনেছিলেন এবং হেফাজতীদের সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী অরাজনৈতিক ও ঈমানী শান্ত মুসলমান ভেবেছিলেন। গাড়ি পুড়তে দেখে তা মনে করে অনুশোচনায় ভুগছিলেন। হেফাজতী নেতারাও নাকি লন্ড্রি থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে এনেছিলেন এবং ক্ষমতা নেয়ার সময় টুপি পরবেন না পাগড়ি পরবেন এ নিয়ে নাকি মৃদু দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিফলন দেখি ৫ তারিখে হেফাজতের জনসভায় যেখানে কিছু নেতার মাথায় ছিল টুপি, কিছু নেতার মাথায় পাগড়ি।
(চলবে)
বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০১৩, ২৬ বৈশাখ ১৪২০
Also Read:
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ويقترح رجل الله يتصرف
†f‡¯Í †Mj †eMg wRqvi Ôeøy wcÖ›UÕ
http://www.amadershomoy2.com/content/2013/05/07/news0036.htm
হেফাজতের পাশে থাকার আহবান খালেদার
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=0be0cde05c6adb6ffd4a6cdd81f64bfc&nttl=05052013194180
বন্ধুর পথে বিএনপি
__._,_.___