আর একদিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি, জাতি হিসেবে তার আত্মত্যাগ, মর্যাদা প্রাপ্তিকে শোক ও গৌরবের মধ্য দিয়ে স্মরণ করবে এদিন। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালির ভাষা রক্ষার একটি আন্দোলন নয়, এটি বাঙালির শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশের অনুপ্রেরণাও। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। একুশের চেতনা ভাবীকালেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য একুশে পদক-২০১৭ পেতে যাওয়া ভাষাসৈনিক অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল এ অর্জনের নেপথ্যে থাকা অদম্য সাহসী এ ভাষাসংগ্রামীর আত্মনিবেদনের কথা তুলে ধরছেন নাসরিন শওকত
নারীকথা: ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ভাষাসৈনিক হিসেবে এবারের একুশে পদকের জন্য মনোনয়ন পাওয়ায় আপনার অনুভূতি কেমন?
শরিফা খাতুন : এখন মাত্র মনোনয়ন পেয়েছি। যখন আন্দোলন করেছি, তখন কোন পুরস্কার বা স্বীকৃতির প্রত্যাশায় তা করিনি। আমাদের ছাত্র সমাজ জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। সে দাবি আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুশি। এ কারণে যে, এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ভাষার জন্যই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলাম। এ বিষয়টি আনন্দের। এবং যে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকার আমাকে মনোনীত করেছে, সেটাও আমি মনে করি যে, একই ফলশ্রুতি। এ সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সম্মান জানাতে চায় সরকার। তাদের আনন্দ দিতে চায়_ আমি মনে করি, এটা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত। যারা পেয়েছেন তারাও খুশি এবং আগামীতে যারা পাবেন_ এ আনন্দ তারাও মনে-প্রাণে গ্রহণ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
নারীকথা : এ আন্দোলনের প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে?
শরিফা খাতুন : ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৯৪৮ সালে আমি ছিলাম নোয়াখালী উমা গার্লস স্কুলের (বর্তমানে সরকারি স্কুল) অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুলের মাঠে তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল হতো। মিছিলের নেতৃত্ব দিতেন নবম শ্রেণীর ছাত্রীরা। আমরা তাদের নেতৃত্বে মিছিলে অংশ নিতাম, মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে সেস্নাগান দিতাম। স্কুলের গ-ি পেরিয়ে কলেজে পা রাখি ১৯৫১ সালে। নোয়াখালী ছেড়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হই ইডেন কলেজে। থাকতাম কলেজ সংলগ্ন ছাত্রী হোস্টেলে। আমাদের হোস্টেলটি ছিল বকশীবাজারে।
আমার বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। ভাষা আন্দোলনের আগে বাবার পোস্টিং ছিল শ্রীমঙ্গলে। চাকরিস্থল থেকে বাবা আমাকে কলেজের ঠিকানায় যেসব চিঠি পাঠাতেন সেসব চিঠিতে ডাকা বিভাগের সিলের ভাষার পরিবর্তন আমাকে ভাবিত করত। চিঠি বা পোস্টকার্ডে এর আগে ডাক বিভাগের বাংলা সিল লাগানো থাকত। কিন্তু বাংলা সিল পাল্টে তখন উর্দু আর ইংরেজি ভাষার সিল ব্যবহার শুরু করেছিল ডাক বিভাগ।
বাবার পাঠানো চিঠির খামে বাংলার পরিবর্তে কিভাবে উর্দু জায়গা করে নিল সেটা নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম। কলেজ প্রাঙ্গণের লিচু গাছের নিচে, কমনরুমে, মাঠে প্রভৃতি স্থানে আমরা সহপাঠীরা যখন একত্রিত হতাম তখন ডাক বিভাগের সিলের ভাষার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতাম। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের চিন্তা তখনো আমার মনে দানা বাঁধেনি।
'৫২-এর জানুয়ারিতে খাজা নাজিমউদ্দীন যখন ঘোষণা দিলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তখন তার বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তার প্রতিক্রিয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা হয়। '৫২-এর ফেব্রুয়ারির দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কয়েকটি সভায় আমি এবং আমার বেশ কয়েকজন সহপাঠী উপস্থিত ছিলাম।
নারীকথা: কোন সময়ে এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ?
শরিফা খাতুন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উইমেন্স হল (প্রথমে চামেলি হাউজ ছিল যা বর্তমান রোকেয়া হল) থেকে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রী ইডেন কলেজে এসে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। রোকেয়া হলের সেই আপারাই আমাদের বলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভা হবে, আমরা যেন সেই সভায় উপস্থিত হই।
আমাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য অধ্যাপক শাফিয়া খাতুন (পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার সহকর্মী ছিলেন), রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন, জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, অধ্যাপক সারা তৈফুর মাহমুদসহ (পরবর্তীকালে ময়মনসিংহ উমেন্স ট্রেনিং কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন) তাদের সঙ্গে আরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আপারা ইডেন কলেজ প্রাঙ্গণের লিচু গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। তারা বলতেন, পাকিস্তানিরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপেক্ষা করছে। আমরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম করছি। এ আন্দোলনে তোমারও যোগ দিবে। জানুয়ারির শেষদিকে একদিন কলেজে এসে এক সভায় তারা বললেন, খাজা নাজিমউদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছে। এর প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৪ ফেব্রুয়ারি সভা আহ্বান করেছে। তোমরা সেই সভায় উপস্থিত হবে। সেদিন আপাদের বক্তব্য শুনে আমাদের মনে হলো, এবার একটি অন্যরকম আন্দোলন হতে যাচ্ছে। তখনও অবশ্য আমরা ভাষা আন্দোলনের বিশালত্ব বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এ কথা ঠিকই আমাদের মনে হয়েছিল যে, মাতৃভাষা রক্ষার এই আন্দোলনে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের কলেজে ছাত্রী সংসদ ছিল। এর সেক্রেটারি ছিলেন রওশন আরা দুলু। তিনি তখন বি এ ক্লাসের ছাত্রী ছিলেন, সম্ভবত চতুর্থ বর্ষে পড়তেন। ইডেনে ছাত্রীদের সভার আয়োজন তিনিই করতেন। দুলু আপা আমাদের ডেকে বললেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে পোস্টারগুলো তোমরা প্রচার কাজের জন্য কপি কর। আমরা যারা হোস্টেলে থাকতাম তারা পোস্টার লিখতাম। সেই পোস্টার কলেজে ও হোস্টেলে লাগাতাম। এভাবে আমরা ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছি।
নারীকথা : ২১ শে ফেব্রুয়ারির সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য আপনাদের কী পরিকল্পনা ছিল?
শরিফা খাতুন : সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ছাত্রধর্মঘট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। আমরা সেদিনের সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মাইকে ঘোষণা করা হলো ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ হলো। আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই যে, এর মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ হবে কিনা। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এই অবস্থায় কী সিদ্ধান্ত নেন সেটা জানার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে যাওয়ার জন্য ব্যানার, ব্যাজ প্রস্তুত। ২০ ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে কালো ব্যাজ দেওয়া হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সে ব্যাজ পড়ে ব্যানার নিয়ে ইডেনের ছাত্রীদের সমাবেশে যাওয়ার কথা। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা কি ১১টায় হোস্টেলে খবর এল, ২১ ফেব্রুয়ারির সভা পূর্বনির্ধারিত স্থানেই অনুষ্ঠিত হবে। তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে।
নারীকথা : সেই উত্তাল দিনের কথা বলুন।
শরিফা খাতুন : আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে উঠে দেখি হোস্টেলের গেটে তালা দেয়া, দারোয়ান পাহারারত। হোস্টেলের গেটে প্রতিদিন একটি তালা লাগানো হলেও সেদিন লাগানো হয়েছে দুটো তালা। সে সময় আমাদের হোস্টেল সুপার ছিলেন আরবির অধ্যাপক হালিমা খাতুন। আমরা সুপার আপাকে কিছু না জানিয়ে হোস্টেলের দেয়াল টপকে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেই। কেউ ইকবাল হলের দিক দিয়ে, কেউ বকশীবাজরের রাস্তার দিক দিয়ে গাছে চড়ে দেয়াল টপকে পার হয়ে যাই। ইডেন কলেজের হোস্টেল থেকে ২০-২৫ জন ছাত্রী সেদিন ব্যানার নিয়ে বের হয়। সকাল ৯টা কি সাড়ে ৯টার দিকে সভাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেই। আমরা সবাই একসঙ্গে না গিয়ে কয়েকজনের দল করে সভাস্থলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম রাস্তায় পুলিশ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
আমতলায় গিয়ে দেখি সভাস্থল লোকে লোকারণ্য। আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসলাম। কামরুন্নেসা এবং মুসলিম গার্লস স্কুলসহ আরও স্কুল থেকে মেয়েরা সভায় এসেছে। আমরা কয়েকদিন আগে মুসলিম গার্লস স্কুলের মেয়েদের পোস্টার আর ব্যাজ দিয়ে এসেছিলাম। প্রায় শ' খানেকের মতো ছাত্রীরা সেদিন সভায় উপস্থিত ছিল। আমতলায় মিটিং শুরু হয় বেলা ১১টার দিকে। সভা শেষে ছোট ছোট দল করে মিছিল জগন্নাথ হলের (তখন পূর্ববঙ্গের আইনসভা চলছিল) দিকে যাত্রা শুরু করে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি স্মারকলিপি আইনসভার অধিবেশনে দেয়ার উদ্দেশে এ যাত্রা।
কয়েকটা দল মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর দেখি মিছিল আর এগুচ্ছে না। আমরা যারা পেছনের দিকে ছিলাম তারা বুঝতে পারছিলাম না যে, মিছিলের সামনে কী হচ্ছে। একটু পরে শুনতে পেলাম, পুলিশ মিছিল থেকে ছাত্রছাত্রীদের ধরে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। টিয়ার গ্যাসও ছোড়া হয়। বিকাল তিনটার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। আমি জীবনে সেদিনই প্রথম গুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর সমস্ত মাঠ প্রায় খালি হয়ে গেল। আমরা মেয়েরা তখন অসহায় বোধ করলাম। তখনো অবশ্য সেখানে বেশ কিছু ছাত্র ছিল। আমার বান্ধবী রওশন আরা হেনার ভাই জাহাঙ্গীর তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি ও আরও কয়েকজন ছাত্র আমাদের অভয় দিয়ে বললেন, তোমরা ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাদের হোস্টেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। ছাত্রদের মিছিলের ওপর গুলি করায় কতজন হতাহত হয়েছেন, সেটা তখন তিনি বলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর ওনারা আমাদের মেডিকেল কলেজ ও কলা ভবনের মাঝখানের একটি সদ্য ভাঙা দেয়ালের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে কলেজ হোস্টেলে পেঁৗছে দিলেন। আর অন্য মেয়েদের বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করে দিলেন। পরে জেনেছি, পরে জেনেছি, দেয়াল ভেঙে আমাদের পথ করে দেয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ইডেন কলেজের জিএস রওশন আরা দুলুসহ আমরা কয়েকজন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ আহত হয়েছেন। আহাজারি করছেন তারা। মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষার্থীরা আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। সেখানে শুনলাম, ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। শুনে আমারা মর্মাহত হলাম। লাশ গুমের কথাও শোনা গেল। অনেকে বলছে, মিছিলে মারা যাওয়া অনেকের লাশ পুলিশ গুম করেছে। তখনও অবশ্য আমরা ভাষা শহীদদের নাম জানতে পারিনি। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরও আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন থেমে থাকেনি।
নারীকথা: আপনাকে ধন্যবাদ।
__._,_.___