বুধবার আলজাজিরা প্রচার করেছে অসত্য সংবাদ ॥ আরও সাংবাদিক আনতে জামায়াত ব্যয় করছে প্রচুর অর্থ
ফিরোজ মান্না ॥ আলজাজিরার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরো কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশনের অংশ হিসেবে এজন্য ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইতোমধ্যেই জামায়াতের প্রচেষ্টায় এদেশে এসেছিলেন আলজাজিরার সাংবাদিক নিকোলাস হক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তার তৈরি করা প্রতিবেদনটি গত বুধবার আলজাজিরায় প্রচারও হয়েছে। অবশ্য জামায়াতের পরিকল্পনা মতো প্রতিবেদনটির গোলাম আযমের সাক্ষাতকার গ্রহণ করতে পারেননি ওই সাংবাদিক। তবে এই মিশন সফল করার জন্য জামায়াত বিবিসিসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদককে ঢাকায় আনার জন্য জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছে বলে সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে স্পীকার আব্দুল হামিদের সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের বেসরকারী দিবসে এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ সংসদে এ প্রস্তাব আনেন। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান আমিরসহ ছয় নেতা এবং বিএনপির এক সংসদ সদস্যসহ দুই নেতার বিচার চলছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করে আলজাজিরার প্রতিবেদক নিকোলাস হককে ঢাকায় আনা হয়েছিল। তিনি ঢাকায় প্রায় এক মাস অবস্থান করেন। আলজাজিরার প্রতিবেদক ঢাকায় গোলাম আযমের সাক্ষাতকার নেয়ার ব্যাপারে গত ৭ ফেব্রæয়ারি ''প্রিজন সেলে গো. আযমের সাক্ষাতকার নিতে চায় 'ঢাকায় আলজাজিরা' সাংবাদিক নিকোলাস, যুদ্ধাপরাধী বিচার ঠেকাতে নতুন জামায়াতী কৌশল, উভয় সঙ্কটে সরকার, ডাক্তার ও পুলিশের যোগসাজশ!'' শীর্ষক শিরোনাম ও উপশিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পর সরকারের ওপর মহলের টনক নড়ে। প্রিজন সেলে বন্দী গো. আযমের সাক্ষাতকার নিতে সুযোগ পাননি সাংবাদিক নিকোলাস হক। তবে নিকোলাস হাল ছাড়েননি। নানাজনের সঙ্গে কথা বলে বুধবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। টিভি চ্যানেলটির অনলাইনেও এ বিষয়ে 'বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
নিকোলাস তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন, বাংলাদেশের সাবেক রাজনীতিবিদ গোলাম আযম ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। ৮৯ বছর বয়সী গোলাম আযম হাঁটতে পারেন না, দেখতে পান না, এমনকি শুনতেও পান না। এরপরও ১০ জন সশস্ত্র পুলিশ সার্ব¶ণিক তাঁকে পাহারা দিচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রæপ এক শুনানিতে গোলাম আযম ও অন্য অভিযুক্তদের আটক করে রাখার বিষয়টিকে অযৌক্তিক ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে অভিহিত করা হয়েছে। নিকোলাস হক আইনমন্ত্রীকে কোট করেছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নয়। এটি দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। তাই যাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, তাদের আটক অবৈধ নয়।
প্রতিবেদনে গোলাম আযমের বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, গোলাম আযম দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত যাই আসুক না কেন, এর পরিণতি হবে নাটকীয়। এটা অনেকের কাছেই সুবিচার বলে মনে হবে। কিন্তু পরিণতিতে দেশ নিপতিত হবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে।'
গত ৭ ফেব্রæয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এবার জামায়াত নতুন কৌশল বেছে নিয়েছে। বিরাট অংকের টাকা ব্যয় করে বিদেশী প্রচার মাধ্যমের সংবাদিকদের ঢাকা আনতে শুরু করেছে। 'আলজাজিরা' টেলিভিশনের এক সংবাদিক ঢাকায় এসেছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের সাক্ষাতকার নিতে। ওই সংবাদিক ইতোমধ্যে গোলাম আযমের সাক্ষাতকার নেয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন। আগামী বুধবার দিনের যে কোন সময় এই সাক্ষাতকারটি নেয়া হবে। আলজাজিরা টেলিভিশনের সাংবাদিক নিকোলাস হক একটি বিশেষ 'এ্যাসাইনমেন্টে' আসেন। বিষয়টি একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরে সরকারের ওপর মহলে বিষয়টি জানায়। সাংবাদিক নিকোলাস বাংলাদেশে এসেই তিনি গ্রামীণফোনের একটি সংযোগ নেন। সাংবাদিক নিকোলাস বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতার সঙ্গে কথা বলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার্থে বিশ্ব জনমত পাল্টে দিতে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের সাক্ষাতকারও থাকবে। বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও আলজাজিরার ওই সাংবাদিক গোলাম আজমের সাক্ষাতকার নেয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে আটক গোলাম আযমের সঙ্গে তিনি একদফা কথা বলেছেন। আল জাজিরার ওই সাংবাদিকের এই এ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারে সরকারের ওপর মহলে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দফতরকেও অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ নেবে তা জানা যায়নি।
প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, নিকোলাস হকের পর এবার তারা আরও মিডিয়ার সাংবাদিকদের ঢাকায় আনার জন্য বিরাট বাজেট করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিবিসি টেলিভিশন, নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, দ্য ইকোনমিস্টসহ বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার সাংবাদিকের দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এতে বিশ্ব জনমত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে চলে যাবে। তখন বিচার ¯^চ্ছ হলেও নানা প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে জামায়াতীরা। প্রথমে তারা বিদেশী আইনজীবী দিয়ে আইনী লড়াই করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ না থাকার কারণে এখন তারা বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব জনমত তাদের পক্ষে নেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসছে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ঘোষণা দেয়। বিদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী যুদ্ধাপরাধীদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়। এরপরই যুদ্ধাপরাধী চক্র বিচারপ্রক্রিয়াকে ঠেকানোর জন্য দেশে বিদেশে নানা ধরনের লবিং শুরু করে। যুদ্ধাপরাধীরা সংঘবদ্ধ হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য এমন কি আমেরিকায় তারা বিভিন্ন পর্যায়ে 'লবিষ্ঠ' নিয়োগ করেছে। এরপর সরকারের বলিষ্ঠ অবস্থানের কারণে ৮ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। এই ৮ জনের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অপরাধীরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও ঐতিহাসিক ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকেও পাল্টে ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। তারা জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জামায়াতীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন জানিয়েছে, সরকারের কোন অবস্থাতেই বিদেশী মিডিয়াকে যুদ্ধাপরাধী পক্ষে সংবাদ প্রচারের সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। এমন সংবাদ প্রচার হলে বিচার বাধাগ্রস্থ হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক এটা দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি।