একাত্তরে কি ভেবেছিলেন যে আবার এমন দৃশ্য দেখতে হবে?
বড় কষ্টে আছি, না পারছি কিছু কইতে, না পারছি সইতে। গল্পে আছে, এক বালক-কে নিষেধ করা হয় যে, তুই এটা করতে পারবি না, ওটা করতে পারবি না' ইত্যাদি। বালক তখন বলে, তাহলে আমি কি করুম? উত্তর, তুই 'কিও' করতে পারবিনা। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বুদ্দিজীবিদের অবস্থাটাও অনেকটা এখন ওই রকম! তারা সরকারের বিপক্ষেও বলতে পারছেননা; পক্ষেও কথা বলছেন না। এক ভদ্রলোকের প্রথম ছেলে হয়েছে; তার খুশিতে হাসার কথা। একই সময়ে দেশের বাড়ী থেকে খবর আসে তার বাবা মারা গেছেন। ভদ্রলোক বুঝতে পারছিলেননা তিনি কি করবেন! তখন একজন প্রবীন পরামর্শ দেন যে, তুমি 'হা' করে থাকো। যুবকের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে প্রবীন বললেন, এতে কেউ ভাববে তুমি পুত্রের আনন্দে হাসতে হাসতে 'হা' হয়ে গেছো; আবার অন্যরা ভাববে বাবার শোকে কাঁদতে কাঁদতে তোমার এ দশা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল বুদ্দিজীবিদেরও একই অবস্থা।
এ বৃহদাকার সমস্যার সমাধান আছে; সমাধান হবেও। তবে লোকে হয়তো তখন বলবে, 'সেই তো নাচ দেখালি; তবে কেন লোক হাসালি?' ফেইস বুক-এ সদ্য একটি পোস্টিং দেখলাম, যাতে একজন লিখেছেন, 'দুই নেত্রীর জনপ্রিয়তায় জাতি যখন অস্থির, তখন আর এক নেত্রীর উত্থান আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে?' এই নেত্রী হচ্ছেন, বেগম রওশন এরশাদ। আমার আর এক বন্ধু অবশ্য বললেন, স্বৈরাচারী এরশাদের ভেল্কিবাজিতে জাতি বিরক্ত। ওই বুড়া ধূর্ত শিয়াল আর কখনো ৪/৫ টার বেশি সীট পাবেনা, কারণ তিনি জাতির বিশ্বাস হারিয়েছেন।' তিনি এও বললেন, মিয়া-বিবি দুই দিকই রক্ষা করছেন; এরশাদ বিপ্লবী; আর বিবি আপোষ-এর ভূমিকায়। এ যেন, 'চাচা রাজাকার আর ভাইস্তা মুক্তিযোদ্ধা।'
চাচা-ভাইস্থার মনস্ত:ত্ব আসলে আজকের বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারার প্রতিচ্ছবি। চাচা বয়োজেস্ট, তাই চাচার জয়। চাচা কবে ভাইস্থাকে কওমী শিক্ষায় শিক্ষিত করে বসে আছেন, আমরা সেই খবরই রাখিনা। একেবারে রাখিনা বললে ভুল হবে; বলা যায়, আমরাই ধর্মের নামে মৌলবাদকে প্রশয় দিয়েছি। দুধ-কলা দিয়ে আমরাই সাপ পুষেছি। 'দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা; শুধিতে হইবে ঋণ।' আমাদের এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু হেফাজতের প্রথম বিক্ষোভের সময় ঢাকা ছিলেন। তারসাথে ছিলেন আর এক মুক্তিযোদ্ধা। ইত্তেফাকের মোড়ে হেফাজতি তান্ডব দেখতে দেখতে বন্ধু অপর মুক্তিযোদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'দাদা, একাত্তরে কি ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশে আবার এমন দৃশ্য দেখতে হবে?' বন্ধুই উত্তর দেন, না ভাবেননি; তবে ভাবা উচিত ছিলো। এরকম হবার কারণ কি জিজ্ঞাসা করলে বন্ধু উত্তর দেন: 'মুক্তিযুদ্বকালে সাকুল্যে দেড়কোটি মানুষ দেশের বাইরে যান; বাকী ৬কোটি দেশেই ছিলো। এদের অর্ধেকের ঢের কম মুক্তিযুদ্বের পক্ষে ছিলো। বাকিরা ছিলো পাকিস্তানের সমর্থক। ৪২ বছরে বেড়ে ওরা এখন মহীরুহে পরিনত হয়েছে। তদুপুরি, ওদের পক্ষে কেউ আমাদের পক্ষে আসেনি; বরং আমাদের পক্ষে অনেকে ওদের পক্ষে চলে গেছে, যেমন: কাদের সিদ্দিকী; মেজর (অব:) জলিল বা কবি আল-মাহমুদ প্রমুখ এবং এদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।
আমরা স্বীকার করি বা না করি, মানি বা না মানি, এবং কারণ যাই হোক, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। আমাদের সবগুলো রাজনৈতিক দল এজন্যে দায়ী। ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্থানের মধ্যে ক্রিকেট খেলা হলে পিন্ডির সমর্থক বেশি থাকলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেউ হয়তো বলবেন, অথবা সচরাচর আমরা যা বলতে পছন্দ করি বা বলে আত্মতৃপ্ত হই, তা হলো: দেশ নয়, ভালো টীম বলে মানুষ পাকিস্থানীদের সমর্থন করে। ওটা যে সত্য নয় তা তারা জানে; তবু বলে এবং নানান যুক্তি দেখায়। তাদের যুক্তি টেকে না এ কারণে যে, বাংলাদেশ-ভারত খেলা হলে সেটা হয়না। আমাদের পাকিস্থান প্রীতি বা ভারত বিদ্বেষ নুতন কিছু নয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে একটি বিষফোড়া; ধর্মের নামে এমন অপকর্ম নাই যা পাকিস্তানে হয়না। অথচ এই পাকিস্তান প্রেমে বাংলাদেশীরা বিভোর! সুতরাং বাংলাদেশ ধীরলয়ে মিনি পাকিস্তান হবে বা হচ্ছে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এ থেকে পরিত্রানেরও কোন সম্ভবনা এসময়ে দেখিনা।
কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক অনেক সময় নিলেও ধীরে ধীরে মুসলিম উন্মার দিকে হাটছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আসলে ৯/১১-এর পর মুসলিম বিশ্বে যে পরিবর্তন আসা উচিত ছিলো তা আসেনি, বরং উল্টোটা হয়েছে। বাংলাদেশ আধা পাকিস্তানে পরিনত হলে ভালো হবে কি হবেনা সে প্রশ্ন অবান্তর; ঠেকে বা ঠকে তা শিখতে হবে। তবে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ভালো হলে পাকিস্থান-ইরান-আফগানিস্থান বা মিশর-ইন্দোনেশিয়া উন্নত রাষ্ট্র হয়ে যেতো। হয়নি। আবার অন্যভাবে দেখা যাক: 'যদি বলা হয়, বাংলাদেশের সব মানুষকে আমেরিকা বা সৌদি আরব চলে যাবার সুযোগ দেয়া হচ্ছে; ধারণা করি সবাই আমেরিকা চলে আসবেন।' প্রশ্ন করুন: সৌদি আরব নয় কেন? কারণ ওটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র; এমনকি মুসলমানেরও ওখানে সর্বময় স্বাধীনতা নেই! সৌদি আরবে বাংলাদেশীরা 'মিসকিন'; আর আমেরিকায় এমনকি সাদা পুলিশও 'স্যার' বলে সম্বোধন করে!
গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরেপক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যেই ভালো। বাংলাদেশ সেটা বুঝলো না। বুঝলে সবাই মিলে ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করতোনা। বাংলাদেশের মানুষ কারণে-অকারণে, ব্যবসা-পাতি, পড়াশোনা, চিকিত্সা বা বাজার করতেও ভারত-সিঙ্গাপুর-ব্যাঙ্কক-লন্ডন-আমেরিকা ছুটে যায়। এসবগুলো দেশ ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; তাই উন্নত। একথা আমরা ভাবিনা। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষার জন্যে কি পাকিস্তান যাবার কথা ভাবে? চিকিত্সার জন্যে? না, ভাবে না। কারণ, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ভালো কিছু জন্মায় না। রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক না হলে ধর্ম ও রাষ্ট্র দু'টোরই ক্ষতি হয়। এজন্যেই বলা হয়, রাষ্ট্র সবার, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমরা তো সবাই 'রাজা যা বলে পারিষদ বলে শতগুণ'-এর ধারাবাহিকতায় 'আহা বেশ বেশ' কীর্তনেই ব্যস্ত। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হবেনা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নাই; গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাও নাই নাই করছে। সামনে নির্বাচন, ৪২ বছরে আমরা একটি পাকাপোক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থাও গড়তে পারলাম না। তাই প্রতিটি নির্বাচনের সময় যত্তসব হাঙ্গামা। ২০০৭-এর পরও আমাদের শিক্ষা হয়নি; হয়তো হবেও না। দেশ এখন সোজাসুজি দুইভাগে বিভক্ত। একাত্তরেও তাই ছিলো। অনেকে বলছেন, এটা আর একটি মুক্তিযুদ্ব। ১৯৭১ আর ২০১৩-তে যথেষ্ট মিল আছে বটে। একাত্তরে পাকিস্থান ও বাংলাদেশীদের প্রিয় পুরো মুসলিম বিশ্ব আমাদের বিপক্ষে ছিলো; এখনো তাই। আমেরিকাও বিপক্ষে ছিলো এবং এখনো আছে! চীন আগের মত বিপক্ষে। একমাত্র ভারত পক্ষে। ১৯৭১ আর ২০১৩-এর কি আশ্চর্য মিল! একাত্তরে আমরা জিতেছিলাম; এবারো আমাদেরই জেতার কথা। একাত্তরে ভারত একাই আমাদের জিতিয়ে দিয়েছিলো এবং এবারও হয়ত তাই দেবে এবং আমরা যথারীতি বেঈমানি করবো? বেঈমান না হলে কি আমরা বঙ্গবন্ধুকে মারতে পারতাম?
ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যত লাফালাফি করুক না কেন, ওদের ভবিষ্যত বাংলাদেশে অন্ধকার। দক্ষিন এশিয়ায় আর একটি 'মিনি পাকিস্থান' হবে না। আমরা হতে দিতে পারিনা। সরকারের অনেক পদক্ষেপই হয়তো সমালোচনার যোগ্য কিন্তু তবু ধর্মান্ধ শক্তিকে আমরা চাইনা। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। স্বাধীনতার পর সিকি শতাব্দী এর ক্ষমতায় থাকার কথা ছিলো। সেটা হয়নি। লেট বেটার দ্যান নেভার। এখন সেটা হোক। ভারতে কংগ্রেস ও নেহেরু সবাই-কে সাথে নিয়ে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্বতিতে সিকি শতাব্দী রাজত্ব করেছেন।আমাদের নেতা-নেত্রীরা অনেক বেশি বুঝেন, তাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না। ২০০৮-এর নির্বাচনে জাতি আমাদের সবকিছুই দিয়েছিলো, কিন্তু আজকের অবস্থা দেশবাসী চায়নি। পরিকল্পনা ও সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেশ ,দল ও আমরা সবাই বেচে যাই।
শিতাংশু গুহ
২৮শে ডিসেম্বর ২০১৩।
নিউইয়র্ক।
__._,_.___