সিদ্দিক আলম দয়াল, গাইবান্ধা থেকে: রাজনীতি না করেও জীবন দিতে হলো দিনমজুর নুরন্নবী মিয়াকে। প্রতিদিনের মতো হাতে কোদাল আর ঘাড়ে গামছা নিয়ে কাজে বের হচ্ছিলেন । কিন্তু তাকে জীবন দিতে হলো মানুষের লাঠি আর লাথির আঘাতে। তার রক্তাক্ত গামছা নিয়ে বিলাপ করছিলেন স্ত্রী মিনা বেগম; গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গঙ্গারহাট পরান গ্রামে। দিনমজুর পিতা মাল হকের দ্বিতীয় ছেলে নুরন্নবী মিয়া। পিতার জমিজমা নেই। আছে বাড়ি ভিটা। তিন ছেলেই অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। দিন আনা দিন খাওয়ার সংসারে তাদের সবার খাবার জোটে কাজের ওপর। আর ছেলেদের কামাইয়ের ওপর ভাত জুটতো তার মা সমস্তভান বেগমের। কাজ পায়নি তাই আগের দিন স্ত্রী মিনা বেগম ও তার দুই সন্তানের জন্য ১ কেজি চাল বাকিতে কিনে এনেছিলেন গংসার হাটের আজিজ মিয়ার দোকান থেকে। কাজ করে সেই টাকা শোধ করার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী পান্তা খেয়ে নুরন্নবী মিয়া কাজের খোঁজে কোদাল আর ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে বের হয়ে যান। কিন্তু বাজারে যেতেই সহস্র্রাধিক লোক লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় গংসারহাটের দোকান বাড়িঘরে। চিৎকার করে নুরন্নবী বলছিলেন, 'কি হচে বাহে তোমার ঘরে।' তার উত্তর পাওয়ার আগেই লোকজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মরণ চিৎকার দিয়ে নুরন্নবী বলছিলেন, 'হামাক মারেন ক্যা।' ওরা বলে, 'গ্রাম জ্বলে দেমো। এ গ্রামে কোন মানুষ থাকে না। শালার ব্যাটা আওয়ামী লীগের বাচ্চা দেখি তোরা কি করবার পাস।' তার চিৎকার শুনে গ্রামের অনেকেই এগিয়ে আসেন। মিছিলকারী জামায়াত-শিবিরের লোকজন তাদেরও মারপিট করে। বাধ্য হয়ে গ্রামের এবং বাজারের সবাই তাদের মারের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে যান। বেধড়ক মার খেয়ে নুরন্নবীর নিথর দেহ পড়ে থাকে পরান গ্রামের সোঁদা মাটিতে। সারা শরীরে রক্তের ছাপ। খবর পেয়ে ছুটে আসেন নুরন্নবীর ভাই, মা, বাবাসহ তার গ্রামের অনেকেই। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের তাড়া খেয়ে তারাও পালিয়ে যায়। ছেলের লাশ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে কষ্টের আর কি থাকতে পারে- এ কথা বলেন তার বৃদ্ধ পিতা মাল হক। গ্রামে হানাহানির খবর পেয়ে সুন্দরগঞ্জ থেকে আসে পুলিশ। তারা স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে এগিয়ে যান ওই গ্রামে। পুলিশ দেখে সশস্ত্র লোকজন অবস্থান নেন পাশের বেলকা গ্রামে। তারপর বেলা ১১টার দিকে পুলিশ নুরন্নবীর লাশ শনাক্ত করে। পুলিশ দেখে আশপাশের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে তার স্ত্রী মিনা বেগমসহ তার স্বজনরা এগিয়ে আসেন। স্ত্রী মিনা বেগম স্বামীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে অচেতন হয়ে পড়েন। তার পিতা মাল হক চিৎকার করে বলেন, আমার ছেলে নুরন্নবী একজন কামলা। মানুষের জমিতে কাজ করে পেটের খাবার যোগাড় করে। এখন তার স্ত্রী আর দুই সন্তানকে কে খাওয়াবেন? বড় মেয়ে আলেমা বাবার মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা রক্তাক্ত গামছা নিয়ে বারবার বুকে জড়িয়ে কাঁদছিলেন। পিতার রক্তে ভেজা গামছা নিয়ে বিলাপ করছিলেন মেয়ে আলেমা। আলেমা বলেন, আমার আর পড়ালেখা করা হলো না। বাবা আমাকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। বলেছিল, মা আমি কামলা। আমার মেয়ে আলেমা পড়ালেখা করে শিক্ষক হবে। এই আশায় নুরুন্নবী তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু তার আশা তো পূরণ হলোই না। এখন আমাদের পেটে ভাত যোগাড় হবে কোথায় থেকে- এই ভাবনা এখন নুরন্নবীর পরিবারের। তার স্ত্রী তখনও স্বামীর লাশের পাশে কাঁদছিলেন। কারণ লাশের আশপাশে পুলিশ। পুলিশকে বলছিলেন, আমার স্বামীকে তো মেরেই ফেলেছেন, এখন আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু নাছোড়বান্দা; পুলিশ ছাড়তে রাজি নয়। পুলিশ লাশ নিয়ে যায় থানায়। তার স্বজন ও নিহত নুরন্নবীর স্ত্রীর আহাজারিতে গ্রামের সবার চোখে পানি এসে যায়। এই খুনের ঘটনায় এলাকায় অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলতে পারে না রাজনীতি করে না বলে নুরন্নবীকে জীবন দিতে হলো । রাজনীতি না করে কামলা দিয়ে খাওয়াই তার অপরাধ। স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান জানান, নিহত নুরন্নবী খুব দরিদ্র। সে আমার বাড়িতেও কাজ করেছে। একদিন কাজ না করলে যাকে না খেয়ে থাকতে হয় সেই নুরন্নবীর স্ত্রী, দুই সন্তান, মা ও বাবার পেটের ভাত যোগাড় হবে কেমন করে- এ প্রশ্ন এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। স্ত্রী মিনা বেগম জানান, আমার স্বামীকে যারা হত্যা করলো তাদের সবাই কে চেনে মানুষ। পুলিশ কেন তাদের গ্রেপ্তার করছে না। পুলিশ মরলে বিচার হয় আর আমার নির্দোষ স্বামীকে হত্যা করলে কোন বিচার হবে না- তা হবে না। সন্ধ্যায় নুরন্নবীর লাশ মর্গে পাঠানো হয়। এদিকে গ্রামজুড়ে সুনসান নীরবতা । সহিংসতায় নুরন্নবীর মতো আরও কতো নিরীহ দিন মজুরকে জীবন দিতে হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াহেদুজ্জামান বাদশা বলেন, নিহত নুরন্নবীকে কেন হত্যা করা হলো তা আমারও প্রশ্ন। আমরা বুঝতেই পারিনি জামায়াতের লোকজন ফজরের নামাজের পর এই গ্রামে এসে হঠাৎ হামলা চালাবে।
- See more at: http://www.mzamin.com/details.php?nid=NDQ3MDA=&ty=MA==&s=Mjc=&c=MQ==#sthash.qyZFwvvi.dpuf__._,_.___